আল্লাহ তাআলা সর্বযুগে সব জাতির কাছে নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘প্রতিটি জাতির জন্য পথ-প্রদর্শনকারী রয়েছে।’ (সুরা : আর রাদ, আয়াত : ১৩) অন্যত্র ইরশাদ করেছেন, ‘আমি রাসুল প্রেরণ না করে কাউকে শাস্তি দিই না।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ১৬৫)
সব নবী-রাসুলের কোনো না কোনো পেশা ছিল, তাঁরা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতেন না। বরং স্বীয় হস্তে অর্জিত জিনিস ভক্ষণ করাকে পছন্দ করতেন। মহানবী (সা.)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কোন ধরনের উপার্জন উত্তম ও শ্রেষ্ঠ? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, ব্যক্তির নিজ হাতে কাজ করা এবং সৎ ব্যবসা। (সুয়ুতি আদদুররুল মানসুর, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২২০) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হালাল রুজি অর্জন করা ফরজের পর একটি ফরজ।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
ঈসা (আ.) এক ব্যক্তিকে অসময়ে ইবাদাতখানায় দেখে প্রশ্ন করলেন, তুমি এখানে বসে ইবাদত করছ, তোমার রিজিকের ব্যবস্থা কে করে? লোকটি বলল, আমার ভাই আমার রিজিকের ব্যবস্থা করে। ঈসা (আ.) তাকে বলেন, সে তোমার চেয়ে অনেক উত্তম। (হেদায়াতুল মুরশিদিন)। কবির ভাষায়, ‘নবীর শিক্ষা কোরো না ভিক্ষা, মেহনত করো সবে।’ নবী-রাসুলরা হলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব। তাঁরা স্বহস্তে অর্জিত সম্পদে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
আদম (আ.) ছিলেন একজন কৃষক। তিনি চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁর ছেলেদের পেশাও ছিল চাষাবাদ। তা ছাড়া তিনি তাঁতের কাজও করতেন। কারো কারো মতে, তাঁর পুত্র হাবিল পশু পালন করতেন। কৃষিকাজের যন্ত্রপাতির নাম আল্লাহ তাআলা তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন—আল্লাহর বাণী, ‘আর আল্লাহ আদমকে সব নামের জ্ঞান দান করেছেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৩১)
শিস (আ.)ও কৃষক ছিলেন। তাঁর পৌত্র মাহলাইল সর্বপ্রথম গাছ কেটে জ্বালানি কাজে ব্যবহার করেন। তিনি শহর, নগর ও বড় বড় কিল্লা তৈরি করেছেন। তিনি বাবেল শহর প্রতিষ্ঠা করেছেন। (ইবনে কাসির)
ইদরিস (আ.)-এর পেশা ছিল কাপড় সেলাই করা। কাপড় সেলাই করে যে অর্থ উপার্জন করতেন, তা দিয়ে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। ইদরিস শব্দটি দিরাসা শব্দ থেকে নির্গত। তিনি বেশি পরিমাণে সহিফা পাঠ করতেন বলে তাঁকে ইদরিস বলা হয়। পড়াশোনার প্রথা তাঁর সময় থেকে চালু হয়। একদল পণ্ডিত মনে করেন, হিকমত ও জ্যোতির্বিদ্যার জন্ম ইদরিস (আ.)-এর সময়ই হয়েছিল।
নুহ (আ.) ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। আল্লাহ তাআলা তাঁকে নৌকা তৈরির কলাকৌশল শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং আল্লাহর নির্দেশে তিনি নৌকা তৈরি করেছিলেন। আল্লাহর বাণী—‘আর তুমি আমার তত্ত্বাবধানে ও আমার ওহি অনুযায়ী নৌকা নির্মাণ করো।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৩৭) তিনি ৩০০ হাত দীর্ঘ, ৫০ হাত প্রস্থ, ৩০ হাত উচ্চতাসম্পন্ন একটি বিশাল নৌকা তৈরি করেন।
হুদ (আ.)-এর জীবনী পাঠান্তে জানা যায় যে তাঁর পেশা ছিল ব্যবসা ও পশু পালন। ব্যবসা ও পশু পালন করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন।
সালেহ (আ.)-এর পেশাও ছিল ব্যবসা ও পশু পালন।
লুত (আ.)-এর সম্প্রদায়ের লোকেরা চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত ছিল। এতে প্রতীয়মান হয় যে তিনিও জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতেন চাষাবাদের মাধ্যমে।
ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনী পাঠান্তে জানা যায় যে তিনি জীবিকা নির্বাহের জন্য কখনো ব্যবসা, আবার কখনো পশু পালন করতেন।
ইসমাইল (আ.) পশু শিকার করতেন। তিনি ও তাঁর পিতা উভয়ই ছিলেন রাজমিস্ত্রি। পিতা-পুত্র মিলে আল্লাহর ঘর তৈরি করেছিলেন।
ইয়াকুব (আ.)-এর পেশা ছিল ব্যবসা, কৃষিকাজ করা ও পশু পালন।
ইউসুফ (আ.) রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বেতন হিসেবে রাষ্ট্রীয় অর্থ গ্রহণ করতেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমার রব! আপনি আমাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছেন।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ১০১)
শোয়াইব (আ.)-এর পেশা ছিল পশু পালন ও দুধ বিক্রি। পশু পালন ও দুধ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁর কন্যারা চারণভূমিতে পশু চরাতেন।
দাউদ (আ.) ছিলেন রাজা ও নবী। সহিহ বুখারির ব্যবসা অধ্যায়ে রয়েছে যে দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন। তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন, হে আল্লাহ! এমন একটি উপায় আমার জন্য বের করে দিন, যেন আমি নিজ হাতে উপার্জন করতে পারি। অতঃপর তাঁর দোয়া কবুল হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাঁকে লোহা দ্বারা বর্ম ও অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করার কৌশল শিক্ষা দেন। শক্ত ও কঠিন লোহা স্পর্শ করলে তা নরম হয়ে যেত। যুদ্ধাস্ত্র, লৌহ বর্ম ও দেহবস্ত্র প্রস্তুত করা ছিল তাঁর পেশা। এগুলো বিক্রি করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন।
সোলায়মান (আ.) ছিলেন সমগ্র পৃথিবীর শাসক ও নবী। তিনি তাঁর পিতা থেকে অঢেল ধন-সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। তিনি নিজেও অঢেল সম্পদের মালিক ছিলেন। ভিন্ন পেশা গ্রহণ করার চেয়ে নিজ সম্পদ রক্ষা ও তদারকি করাই ছিল তাঁর প্রদান দায়িত্ব। মানব-দানব, পশু-পাখি, বাতাস ইত্যাদির ওপর তাঁর কর্তৃত্ব ছিল। তাঁর সাথি ঈসা ইবনে বরখিয়া চোখের পলক ফেলার আগে বিলকিসের সিংহাসন সোলায়মান (আ.)-এর সামনে এনে হাজির করেন।
মুসা (আ.) ছিলেন একজন রাখাল। তিনি শ্বশুরালয়ে মাদায়েনে পশু চরাতেন। সিনাই পর্বতের পাদদেশে বিরাট চারণভূমি মাদায়েনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। লোকজন সেখানে পশু চরাত। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মুসা (আ.)। আট বছর তিনি স্বীয় শ্বশুর শোয়াইব (আ.)-এর পশু চরিয়েছেন।
হারুন (আ.)-এর পেশাও ছিল পশু পালন। পশু পালন করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন।
ইলিয়াস (আ.)-এর পেশাও ছিল ব্যবসা ও পশু পালন।
আইউব (আ.)-এর পেশা ছিল গবাদি পশু পালন। তাঁর প্রথম পরীক্ষাটি ছিল গবাদি পশুর ওপর। ডাকাতরা তাঁর পশুগুলো লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। (আনওয়ারে আম্বিয়া, ই. ফা. বাংলাদেশ)
ইউনুস (আ.)-এর গোত্রের পেশা ছিল চাষাবাদ। সুতরাং কারো কারো মতে, তাঁর পেশাও ছিল চাষাবাদ।
জাকারিয়া (আ.) ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে মহানবী (সা.) বলেছেন, জাকারিয়া (আ.) কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। তাই তাঁর শত্রুরা তাঁর করাত দিয়েই তাঁকে দ্বিখণ্ডিত করে। (সহিহ বুখারি)
ইয়াহইয়া (আ.) প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে যে তিনি জীবনের একটি সময় জঙ্গলে ও জনহীন স্থানে কাটিয়েছিলেন। আহার হিসেবে তিনি বৃক্ষের লতাপাতা ভক্ষণ করতেন। (আনওয়ারে আম্বিয়া)
জুলকিফল (আ.)-এর পেশা ছিল পশু পালন।
ইয়াসা (আ.)-এর পেশা ছিল ব্যবসা ও পশু পালন।
ঈসা (আ.) ও মরিয়ম (আ.)-এর আবাসস্থল প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি তাদের উভয়কে এক উচ্চ ভূমি প্রদান করেছিলাম, যা সুজলা ও বাসযোগ্য ছিল।’ (সুরা : আল মুমিনুন, আয়াত : ৫০)
এই উচ্চ ভূমি হলো ফিলিস্তিন। তিনি ফিলিস্তিনে উৎপন্ন ফলমূল খেয়ে বড় হয়েছেন। তিনি ঘুরে ঘুরে অলিতে-গলিতে দ্বিনের দাওয়াতি কাজ করতেন। যেখানে রাত হতো, সেখানে খেয়ে না খেয়ে নিদ্রা যেতেন। তাঁর নির্দিষ্ট কোনো পেশা ছিল না।
মহানবী (সা.) ছিলেন একজন সফল ও সৎ ব্যবসায়ী। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ীদের হাশর হবে নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে।’ (আদ্দুররুল মানসুর, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২০) তিনি গৃহের কাজ নিজ হাতে করতেন। বকরির দুধ দোহন করতেন।
নিজের জুতা ও কাপড় সেলাই ও ধোলাই করতেন, গৃহ ঝাড়ু দিতেন। মসজিদে নববী নির্মাণকালে শ্রমিকের মতো কাজ করেছেন। খন্দকের যুদ্ধে মাটি কেটেছেন। বাজার থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘বর্শার ছায়ার নিচে আমার রিজিক নির্ধারণ করা হয়েছে—তথা গণিমতের মাল হলো আমার রিজিক।’ (কুরতুবি, ১৩তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২)
নবী-রাসুলদের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য এই যে বৈষয়িক ধন-সম্পদের প্রতি তাঁদের কোনো আকর্ষণ ছিল না। তাঁরা কখনো ধন-সম্পদ সঞ্চয় করতেন না এবং সঞ্চয় করা পছন্দও করতেন না। তথাপি যেহেতু তাঁরা মানুষ ছিলেন, সেহেতু বৈষয়িক প্রয়োজনে যতটুকু জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজন, ততটুকু সম্পদ অর্জনে বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করেছেন। সদা-সর্বদা নিজেদের কষ্টার্জিত সম্পদ থেকে ভক্ষণ করা পছন্দ করতেন। মানুষদের থেকে কখনো তাঁরা নজর-নেওয়াজ, এমনকি বেতনও গ্রহণ করতেন না।
বরং যথাসম্ভব নিজেদের উপার্জন থেকে গরিব ও দুস্থদের সাহায্য করতেন। সব নবী-রাসুল ছাগল চরাতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এমন কোনো নবী নেই, যিনি ছাগল চরাননি।’ জনৈক সাহাবি প্রশ্ন করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনিও কি ছাগল চরিয়েছেন? প্রত্যুত্তরে রাসুল (সা.) বলেন, ‘হ্যাঁ, আমিও মক্কায় অর্থের বিনিময়ে ছাগল চরিয়েছি।’ বলা বাহুল্য যে মহানবী (সা.)-এর সাহাবিরা অনেকেই ব্যবসা করতেন। বিশেষ করে মুহাজিররা ছিলেন ব্যবসায়ী আর আনসাররা ছিলেন কৃষক।
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।